শেরশাহ ও শূর বংশ

পূর্ব জীবন:-

  • শেরশাহের আসল নাম ছিল ফরিদ ।
  • তিনি সম্ভবত ১৪৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন ।
  • শেরশাহের পিতা হাসান খান শূর বিহারে অবস্থিত সাসারাম অঞ্চলের জায়গিরদার ছিলেন।
  • পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাসারামের জায়গিরদার রূপে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন ।
  • ১৫২২ সালে তিনি বিহারের শাসন কর্তার অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেন ।
  • এই সময়ে তিনি সহস্তে তিনি একটি বাঘ মেরে শের খান উপাধি পান ।
  • কিন্তু তাঁর শত্রুরা তাকে সাসারাম ছাড়তে বাধ্য করেন । তখন তিনি বাবরের অধীনে চাকরি করেন । বাবরই তাকে সাসারাম ফিরিয়ে দেন ।

ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রাজ্য বিস্তার:-

  • বিহারের জায়গিরদার জালাল খান নাবালক বলে তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শের খান। বিহারের শাসন কর্তা জালাল খান নামে মাত্র বিহারের অধীশ্বর ছিলেন । আসল ক্ষমতা ছিল তাঁর অবিভাবক শের খানের হাতে ।
  • চুনার দুর্গ অধীকার করে শের খান আরো ক্ষমতা বৃদ্ধি করলে জালাল খান উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন । তিনি বাংলার সুলতান মামুদ শাহের সঙ্গে মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়ে শের খানকে বাধা দিতে চেষ্টা করেন । কিন্তু শের খান তাদের সুরজ গড়ের যুদ্ধে পরাস্ত করে বিহারে নিজ ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন (১৫৩৪) ।
  • হুমায়ুন যখন গুজরাটে বাহাদুর শাহের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তিনি বাংলা রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন ।
  • হুমায়ুন কিন্তু গুজরাট ও মালয় থেকে ফিরে তাঁকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে আগ্রায় অযথা সময় কাটাতে থাকেন । সেই সুযোগে শের খান আবার গৌড় আক্রমণ করেন । তখন হুমায়ুন অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য অগ্রসর হন । কিন্তু পথিমধ্যে তিনি চুনার দুর্গ আক্রমণ করে (১৫৩৭) অযথা সময় নষ্ট করে শের খানকে বাংলার উপর পুরোপুরি প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ করে দেন ।
  • এরপর শের খান রোটাস দুর্গ দখল করেন । হুমায়ুন তখন বাংলার দিকে অগ্রসর হয়ে গৌড় অধিকার করেন ।
  • শের খান হুমায়ুনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে বিহার ও জৌনপুর দখল করে কনৌজ অগ্রসর হন ।
  • এই অবস্থায় হুমায়ুন বাংলা পরিত্যাগ করে আগ্রা অভিমুখে রওনা হলে শের খান তাকে চৌসার যুদ্ধে (১৫৩৯) পরাস্ত করেন ।
  • এর ফলে শের খান কার্যত কনৌজ থেকে আসাম ও হিমালয় থেকে ঝাড়খণ্ড ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিরাট এলাকার অধীশ্বর হন। এরপর তিনি শেরশাহ উপাধি গ্রহণ করেন ।
  • হুমায়ুন আবার শেরশাহের সঙ্গে ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন । কিন্তু এই যুদ্ধে আবার পরাজিত হয়ে পালিয়ে গিয়ে তিনি পরবর্তী ১৫ বছর ভবঘুরের জীবন যাপন করতে বাধ্য হন । এইভাবে বাবরের সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে (১৫৪০) ।
  • অতঃপর শেরশাহ পাঞ্জাব ও মালয় দখল করেন ।
  • রাজপুতদের পরাজিত করে তিনি রাইসিন দুর্গও দখল করেন । ইতিমধ্যে পাঞ্জাবের শাসন কর্তা সিন্ধু ও মুলতান জয় করেন ।
  • মারওয়ারের রাজপুত রাজা মালদেব তাঁর কাছে পরাজিত হন । এরপর আজমির থেকে আবু পর্যন্ত সমগ্র এলাকা তাঁর করতলগত হয় ।
  • অবশেষে তিনি কালিঞ্জর দুর্গ আক্রমণ করার সময় এক বিস্ফোরণের ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হন ।

শেরশাহের কেন্দ্রীয় শাসন সংস্কার

  • কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং ।
  • রাজকাজে সাহায্যের জন্য তিনি কয়েকজন মন্ত্রী নিয়ােগ করেন—
    • দেওয়ান-ই-ওয়াজিরৎ (অর্থ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী)
    • দেওয়ান-ই-আরিজ (প্রতিরক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী)
    • দেওয়ান-ই-ইনসা ( সরকারি দলিল ও চিঠিপত্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী )
    • দেওয়ান-ই-রসালৎ ( পররাষ্ট্র মন্ত্রী )
    • এ ছাড়া দেওয়ান – ই – কাজী(প্রধান বিচারপতি) , বারিদ – ই – সুমালিক(গুপ্তচর বিভাগের প্রধান) ইত্যাদি উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল ।

শেরশাহের প্রাদেশিক শাসন সংস্কার

  • শাসনের সুবিধার্থে শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি শিক বা সরকারে বিভক্ত করেন । প্রতিটি সরকারে শিকদার-ই-শিকদারান এবং মুনসিফ-ই-মুনসিফান নামক দুজন প্রধান কর্মচারী থাকতেন । তাঁরা যথাক্রমে সাধারণ প্রশাসন এবং বিচার ও রাজস্ব বিভাগ তত্ত্বাবধান করতেন ।
  • প্রতিটি সরকার আবার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল । প্রতিটি পরগনায় শিকদারমুনসিফ নামক দুজন প্রধান কর্মচারী থাকতেন । তাঁদের সাহায্য করতেন কারকুন , আমিন , কানুনগাে , ফোতেদার নামক কর্মচারীরা ।
  • শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম । খুৎ , মুকদ্দম , চৌধুরী , পাটোয়ারী প্রমুখ কর্মচারী গ্রাম – শাসনের কাজে নিযুক্ত থাকতেন । গ্রামশাসনে পঞ্চায়েতের বিশেষ ভূমিকা ছিল । কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য বছর অন্তর তাদের বদলি করা হত ।

শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার

শেরশাহ রাজস্ব ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করেন ।

  • রাজস্ব নির্ধারণের জন্য তিনি সমস্ত জমি জরিপের ব্যবস্থা করেন ।
  • উৎপাদিকা শক্তি অনুযায়ী জমিগুলিকে উৎকৃষ্ট , মাঝারি ও নিকৃষ্ট এই তিন ভাগে ভাগ করেন । উৎপন্ন শস্যের তিন ভাগের এক ভাগ বা চার ভাগের এক ভাগ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হয় । নগদ টাকা বা উৎপন্ন দ্রব্যে রাজস্ব দেওয়া যেত । এই রাজস্ব সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয় । এর ফলে মধ্যস্বত্বভােগী – শ্রেণির শােষণ থেকে কৃষকেরা মুক্তি পায় ।
  • জমির দাগ নম্বর , প্রজার নাম , জমির স্বত্ব ও দেয় রাজস্ব উল্লেখ করে প্রজাকে পাট্টা নামে একটি দলিল দেওয়ার ব্যবস্থা হয় । পরিবর্তে কৃষকও রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার – সহ একটি কবুলিয়ত সরকারকে দিতে বাধ্য থাকে ।
  • দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হলে রাজস্ব মকুব করা হত ।
  • তখন ভারতে নানা ধরনের মুদ্রা চালু ছিল । মুদ্রাগুলিতে ধাতুর মানও নির্দিষ্ট ছিল না । শেরশাহ সােনা , রুপা ও তামার নতুন মুদ্রা চালু করেন । মুদ্রাগুলির মান ( value ) নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । তামার মুদ্রাগুলি ‘ দাম ‘ নামে পরিচিত ছিল ।

শেরশাহের বিচার সংস্কার

  • বিচারব্যবস্থার চূড়ায় ছিলেন সম্রাট শেরশাহ স্বয়ং । তবে বিভিন্ন স্তরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন ।
  • প্রতিটা পরগনায় দেওয়ানি বিচারের দায়িত্ব ছিল আমিন নামক কর্মচারীর ওপর এবং ফৌজদারি বিচারের ভার ছিল কাজীমীর আদল – এর ওপর ।
  • কয়েকটি পরগনার ওপর দেওয়ানি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন মুনসিফ – ই – মুনসিফান নামক কর্মচারী এবং ফৌজদারি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন কাজউকাজাতন বা প্রধান কাজী ।
  • শেরশাহের আমলে দণ্ডবিধির কঠোরতা ছিল । বেত্রাঘাত , অঙ্গচ্ছেদ এবং প্রাণদণ্ড দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল ।

শেরশাহের সেনাবাহিনীর সংস্কার

  • শেরশাহের সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শৃঙ্খলা পরায়ণ । তিনি আলাউদ্দিনের সামরিক রীতির অনুকরণে সেনাবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন অংশের সেনানিবাসে মােতায়েন রাখতেন ।
  • প্রতিটি সেনানিবাসের দায়িত্বে ছিলেন একজন করে ফৌজদার । এ ছাড়া সম্রাটের অধীনে ছিল ২৫ হাজার পদাতিক ও দেড় লক্ষ অশ্বারােহীর এক বিশাল ও সুদক্ষ বাহিনী ।
  • যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রার ফলে ফসল বা সম্পত্তির ক্ষতি হলে শেরশাহ্ রাজকোশ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রীতি চালু করেন ।

শেরশাহের পুলিশবাহিনীর সংস্কার

  • দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার ভার ছিল পুলিশবাহিনীর হাতে । শেরশাহ গ্রামাঞ্চলের শান্তি – শৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রামের মােড়লদের ওপর অর্পণ করেছিলেন । গ্রামে গ্রাম – পঞ্চায়েত ও গ্রাম – প্রধান শান্তি – শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করতেন । সরকারি কর্মচারীরা দেশে চুরি – ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তাদেরই শাস্তি দেওয়া হত । ফিরিস্তা লিখেছেন , শেরশাহের আমলে পুলিশ ব্যবস্থা এতই দক্ষ ছিল যে , পর্যটকরা পথের ধারেই তাদের মূল্যবান দ্রব্যাদি রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমােতে পারতেন । এই বক্তব্য হয়তাে কিছুটা অতিরঞ্জিত ; কিন্তু এ থেকে তখনকার উন্নত আইন – শৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারণা করা যায় ।

যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি

  • সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধার জন্য শেরশাহ বহু রাস্তা নির্মাণ করেন । এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বাংলার সােনার গাঁ থেকে সিন্ধুপ্রদেশ পর্যন্ত নির্মিত রাস্তা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রােড । এ ছাড়া আগ্রা থেকে যােধপুর , আগ্রা থেকে বুরহানপুর প্রভৃতি রাস্তাও শেরশাহের অমর কীর্তি । এর ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যাবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিও সম্ভব হয় ।
  • পথচারীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দু – পাশে তিনি কূপ খনন ও সারি সারি গাছ লাগানাের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের বিশ্রামের জন্য কিছু দূরত্ব অনুযায়ী সরাইখানা নির্মাণ করেন ।
  • শেরশাহ ঘােড়ার পিঠে চড়ে ডাক – চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নত রুপ দেন ।

পরবর্তী শূর শাসকগণ

  • শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ‘ইসলাম শাহ’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন(১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিঃ)।
  • ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র ফিরুজ খানের সিংহাসনে আরোহণ করেন(১৫৫৫ খ্রিঃ)।
  • শের খানের ভাগ্নে মুবারিজ খান ফিরুজ খানকে হত্যা করে ‘মুহম্মদ আদিল’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন(১৫৫৩-১৫৫৫ খ্রিঃ)।
  • মুহাম্মদ শাহ আদিলের উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন ইব্রাহিম শাহ শুরি।
  • ইব্রাহিম শাহ শুরির পর আহমেদ খান "সিকান্দার শাহ শুরি" নাম নিয়ে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন।
  • ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন তাকে পরাজিত করে দিল্লীতে পুনরায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।